আমাদের বাতিঘর
আমাদের স্কুলের পাঠ্য বইতে বেগম রোকেয়া সম্পর্কে পড়ানো হতো। কিন্তু সেখানে তাঁর সম্পর্কে যে ধারণা দেওয়া হতো, সেটা ছিল অসম্পূর্ণ। একটা খণ্ডিত চিত্র মাত্র। তাতে ছকবাধাভাবে বলা হতো তিনি মুসলিম নারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার করেছেন, স্কুল বানিয়েছেন, নারীর কল্যাণে কাজ করেছেন, ব্যস এটুকুই। সম্পূর্ণ রোকেয়া সেখানে অনুপস্থিত। ফলে এই মহীয়সী নারীর পুরোটা উঠে আসেনি আমাদের শৈশবের ক্যানভাসে। বড় হয়ে আর কয়জন তাঁর সম্পর্কে জানার আগ্রহ দেখাই!
শৈশবের ওই জানাটুকু আমাদের মগজে তথ্য হিসেবে থেকে গেছে। তথ্যগুলো ভুল নয় মোটেও। কিন্তু বড় হয়ে যখন তাঁর সম্পর্কে জেনেছি, তখন বুঝেছি কতটা খণ্ডিত রোকেয়াকে পাঠ্য বই তুলে ধরেছে। এমনটা কেন! দুঃখজনক বিষয় হলো তাঁকে আড়ালের এই চেষ্টা দুই দুজন নারী রাষ্ট্রপ্রধানের সময়ও থেমে থাকেনি। বাকিদের সময়কার কথা আর নাই বলি। পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর বাসরত আমাদের সমাজ সচেতনতার সঙ্গে আড়াল করতে চেয়েছে রোকেয়া সম্পর্কিত তথ্য। তাদের ভেতর বুঝি একধরনের ভয় কাজ করেছে– তাঁর দেখানো পথ হয়তো পুরুষতান্ত্রিকতার বিপক্ষে দাঁড়ানোর হাতিয়ার হতে পারে। তাই আমরা জানতে পারিনি, একজন রোকেয়ার সংগ্রাম কেবলমাত্র নারীশিক্ষার বৃত্তে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার পরিধিটা ছিল আরো বিস্তৃত। রোকেয়া এমন একটা সময় নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, সমাজের কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে আগুয়ান ছিলেন, যখন তাঁর সেই কর্মকাণ্ড ছিল দারুণ রকমের নিন্দাযোগ্য।
তিনি একাধারে একজন নারীবাদী, মুক্তমনা এবং লেখক। তাঁর কর্ম, লেখালিখি ও চিন্তা যে কেবল নারীর কল্যাণের জন্য ছিল তা নয়। সবার শুভবুদ্ধি উদয়ের জন্য ছিল সেসব অবারিত। নারীসত্তার তুলনায় পুরুষসত্তাকে আকাশে তোলায় ছিল তাঁর আপত্তি। তিনি চেয়েছিলেন সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নারী-পুরুষ নামের দুই সত্তা কাধে কাধ মিলিয়ে একটা অনাগ্রসর সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথের সঙ্গী হোক একে অন্যের। সমান অধিকার আর সম্মান প্রাপ্ত হোক পরস্পর।
সুবিধাবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গীটিকে কখনোই সহজ মনে গ্রহণ করতে পারেনি- যেকারণে সম্পূর্ণ রোকেয়াকে ধারণ করতে যেমন নিজেরা ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি পাঠ্য বইতে তাঁর সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে দেখা গেছে সীমাহীন উদাসীনতা। আর সে উদাসীনতা চলে এসেছে যুগের পর যুগ। তবে আজকের বাংলাদেশে তাঁকে ঘিরে যে কুৎসিত রাজনীতি আর দীনতার প্রদর্শন চলছে, সেটা বিগত সমস্ত অবজ্ঞা অবহেলাকে টেক্কা দিয়েছে।
রোকেয়ার কর্মকাণ্ডকে আজ মাপা হচ্ছে ধর্মের পাল্লায়। যারা মাপছে তারা একটি বিশেষ গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর মতে, যেহেতু তিনি মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া একজন নারী, তাঁর পর্দার আড়ালে থেকে স্বামী সংসার নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তিনি সেটি না করে পুরুষের পাশাপাশি লেখাজোখা করেছেন। নিজে শিক্ষিত হয়েই ক্ষান্ত হননি– সমাজের অন্য নারীদের শিক্ষিত করায় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। পুরুষের মতো নারীর অধিকার নিয়ে সরব হয়েছেন– আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলটি এবং তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর তাই তাঁর ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ। একজন বেগম রোকেয়া না জন্মালে আমাদের মতো বহু নারীকে আজ হয়তো স্রেফ স্বামী সংসারের জোয়াল বয়ে জীবন পার করতে হতো। ভাগ্যিস বাঙালি নারীরা তাঁকে চিনতে ভুল করেনি। নারীবাদী চিন্তার অন্যান্য নারীরা রোকেয়ার পাঠ থেকেই প্রাথমিক অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তিনি তাদের বাতিঘর হয়ে আলো দেখিয়ে গেছেন। পাঠ্য বইয়ে রোকেয়ার খণ্ডিত উপস্থাপনের হীন মানসিকতার বিপক্ষে হেঁটে চলেছেন বহু নারী-পুরুষ, যারা রোকেয়া নামের মহিয়সী নারীটিকে এক আলোকবর্তিকা মনে করে শ্রদ্ধা জানাতে কুণ্ঠিত নন।
গতবছর থেকে রোকেয়াকে ঘিরে অন্ধকারে আচ্ছন্ন বিশেষ ওই রাজনৈতিক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীটি তাঁকে নিশ্চিহ্নের চেষ্টায় যেন উঠে পড়ে লেগেছে। তাঁরা জানে, মৃত রোকেয়া আজও বৈষম্যহীন সমাজ আর নারীমুক্তির লড়াইয়ে ছায়া হয়ে জড়িয়ে আছেন। সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত এমন কিছু পুরুষ তাই তাঁকে মুরতাদ ঘোষণায় উৎসাহ দেখাচ্ছে। বোধহীন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারী ধর্মের ছুতোয় তাঁকে অপমানের স্পর্ধা দেখাচ্ছে। সেটি কেন, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বোকার দল জানে না মৃতকে হত্যা করা যায় না। আঁকা ছবিতে কালি লেপে দিলেও রোকেয়ার আদর্শকে মুছে দেওয়া যায় না। অন্তরীক্ষ জুড়ে জ্বলন্ত লক্ষ আলোকে অন্ধকারে ঢেকে দেওয়া অসম্ভব।
আজ রোকেয়ার জন্মদিন। তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন