শান্তির ছদ্মবেশে কি স্বাধীনতাহরণ?
নোবেল শান্তি পুরস্কারের কপােলে কলংকরেখা যতদিন যাচ্ছে ততই যেন গাঢ় হয়ে সেঁটে বসছে। প্রতি বছরই অশান্তিতে পটু, বিতর্কিত ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে পুরস্কারটি। ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে যেন শান্তিকে এই মর্মে হুশিয়ার সাবধান করার খেলা শুরু হয়েছে। এবছরও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। বরং এমন একজনের হাতে শান্তির নোবেল তুলে দেওয়া হয়েছে যা রীতিমত অস্বস্তিকর,–অন্তত শান্তির ক্ষেত্রে তো বটেই। যিনি এবছর শান্তির নোবেলটি বগলদাবা করলেন তার অতীত কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা যতটা স্পষ্ট হয়, শান্তির বুক আতঙ্কে ততটাই ধড়াস ধড়াস করে ওঠে।
হুগো শাভেজ ১৯৯৯ সালে যখন ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন, বিষয়টা তখন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি মারিয়া কারিনা মাচোদাকেও অসন্তুষ্ট করেছিল। কেননা হুগো একজন কট্টর বামপন্থী নেতা, যিনি দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মী। ক্ষমতায় এসে তিনি তাদের কথা ভেবেই সামাজিক কর্মসূচি চালু করেন, তেল সম্পদের পুনর্বণ্টন করেন এবং গ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি।
শাভেজের গৃহীত নীতিগুলো সমাজের উচ্চবিত্ত, সামরিক কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীদের অস্বস্তিতে ফেলে। দেশটিকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের ছায়া তখন থেকে সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাজিকরের ইশারায় তলে তলে ষড়যন্ত্র ঘনায়মান হতে থাকে এবং ২০০২ সালের এপ্রিলে সেটা স্বরূপে নাজিল হয়। হঠাৎই রাজধানীতে বিক্ষোভ, সংঘর্ষ, মৃত্যু থাবা বসায়। সেনাবাহিনীর একাংশ শাভেজকে বন্দি করে।
ব্যবসায়ী নেতা পেদ্রো কারমোনা নিজেকে “অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি” ঘোষণা করেন। সেই অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন মারিয়া কারিনা মাচোদা। যিনি এক ধনকুবেরের কন্যা, প্রকৌশলী, এনজিওর পরিচালক, এবং নির্বাচনী পর্যবেক্ষক। সেই ঘোষণায় জাতীয় সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, সংবিধান সব অস্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছিল। গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো এক নিমেষে হাওয়া করে দেবার কর্মসূচি নেওয়া হয়।
কিন্তু মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জনতার ঢেউ, সেনাবাহিনীর চাপ, এবং শাভেজপন্থীদের স্লোগানে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। আবার শাভেজ ফিরে আসেন। ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে আমি কলা খাইনির অভিনয়ে দক্ষ যুক্তরাষ্ট্র তখন বিবৃতি দেয়: “এটি ভেনেজুয়েলার জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন।”
সদ্যই যিনি শান্তিতে নোবেল পেলেন, এই মারিয়া কারিনা মাচোদা কিন্তু সেই সময় বিষয়টাকে খোলা মনে মেনেও নেননি থেমেও থাকেননি। তিনি তার (অ)শান্তিময় কর্মকাণ্ড ঠিকই চালিয়ে গেছেন। ২০১৮ সালে তিনি ভেনেজুয়েলায় সামরিক হামলার আহ্বান জানিয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে চিঠি লেখেন। নিজ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এ এক অনন্য নজির বটে।
নোবেল কমিটি তার গণতন্ত্র(!) প্রতিষ্ঠার পথকে আরো মসৃণ করতেই বুঝি শান্তির নোবেলখানা তার ট্যাকে গুঁজে দিতে দিতে গালভরা বুলি আওড়ালো-- "নোবেল কমিটি জানায়, ‘ভেনিজুয়েলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিরলস প্রচেষ্টা এবং স্বৈরশাসন থেকে ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সংগ্রামের জন্য তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে।" স্বভাবতই তার নোবেলপ্রাপ্তিতে প্রশংসার পাশাপাশি সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তার পুরনো সাক্ষাৎকার সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, “আমি জিতলে আমাদের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হবে!” গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতি তার দ্ব্যর্থহীন সমর্থন বরাবরই ছিল।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ভেনেজুয়েলাকে হুমকি দেন, মারিয়া কারিনা মাচোদা তাতে উচ্ছ্বসিত সমর্থন জানান। নিজের দেশের জনগণের দুর্ভোগকে উপেক্ষা করে তিনি বারবার মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আবেদন করে এসেছেন। ২০২৪ সালে মারিয়া কারিনা মাচোদা ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে ভোটে জয়ী হন। কিন্তু নিকোলাস মাদুরোর সরকার তাঁকে প্রার্থিতা থেকে অযোগ্য ঘোষণা করে। ২০২৫ এর জানুয়ারিতে নিকোলাস মাদুরার শপথ গ্রহণের দিনে তিনি প্রকাশ্যে আসেন এবং নিজেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে বসেন। যা অনেকের কাছে ২০০২ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পুনরাবৃত্তি বলে মনে হয়। তার এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—কিছু দেশ ও গোষ্ঠী আংশিক সমর্থন জানায়, আবার অনেকে তীব্র বিরোধিতা করে।
স্প্যানিশভাষী ২০টি ল্যাটিন দেশের ১৮টিতেই রয়েছে বাম বা মধ্যপন্থী সরকার। ভেনেজুয়েলা বিশ্বের শীর্ষ তেল মজুদকারী দেশ। এই তেলের ওপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদের নজর। কারিনা তাদের প্রতিই নতজানু, তিনি তেল, পানি, অবকাঠামো, সবকিছু বেসরকারিকরণের পক্ষে। “স্বাধীনতা”র নামে তিনি বহুবার ভেনেজুয়েলাতে বিদেশি সেনা হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন। উদ্বেগের হলেও সত্যি, ভেনেজুয়েলার এই বিভীষণ,মারিয়া কারিনা মাচোদাই পেয়েছেন এবারের শান্তির নোবেল পুরস্কার। এবং সেটি নাকি ভেনেজুয়েলার জনগণের শান্তির জন্যই প্রদত্ত! শান্তির পদক পেয়ে তিনি পুরস্কারটির প্রতি লোভাতুরা ট্রাম্পকে ভোলেননি। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে জানিয়েছেন, পুরস্কারটি তিনি তাকেই উৎসর্গ করলেন। আয়রনি বটে!
বহুদিন ধরেই শান্তির কপালে শনি নাচছে। মনোনীত হচ্ছেন আত্মকেন্দ্রিক-স্বার্থপর মানুষজন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে,পুরস্কারটির পেছনে শান্তির তুলনায় রাজনৈতিক ফায়দার বিনিয়োগ ঘটছে বেশি। যার দৃষ্টান্ত চোখের সামনে থাকা বাংলাদেশ- মিয়ানমার। জনগণকে শিখণ্ডী করে শান্তির নোবেলপ্রাপ্ত কারিনার পূর্বসূরী দুজন শান্তির যে ললিতবাণী শুনিয়েছিলেন-- তার অন্তঃস্বারশূন্যতা এখন প্রমাণিত। “স্বাধীনতা”র নামে শান্তির মেডেলধারী মারিয়া কারিনা মাচোদা নিজের দেশকে প্রভুশক্তির হাতে তুলে দেবার আগে জনগণের কথা আদৌও বিবেচনায় রাখেন কি না;---- এবং পূর্বসূরীদের টেক্কা দিয়ে ভেনেজুয়েলার "গণতন্ত্র"কে কোথায় নিয়ে দাঁড় করান সেটাই এখন দেখার বিষয়।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন