বড় বেদনার মতো বাজে...
২০২৩ এর কোনো এক ছুটির বিকেল গড়িয়ে বাইরে যখন গাঢ় সন্ধ্যা নেমেছে, আমি তখন প্রাণপণে একটা বই শেষ করার দৌড়ে। বইটা শেষ করার তাগিদে আমি তখন এতটাই মরিয়া, যে নিমন্ত্রিত হয়ে একজনের বাড়িতে গেছি, সেসব বেমালুম ভুলে বসে আছি। তখন আমার একটাই চাওয়া, যে করে হোক বইটা শেষ করতে হবে। অতটা হুড়মুড়িয়ে কোনো বই পড়েছি কি না মনে পড়ে না। না পড়েই বা উপায় কী, নিমন্ত্রিত বাড়ির গিন্নি, যাকে ভাবি ডাকি, সবেমাত্র বাংলাদেশ থেকে ফিরেছেন, সঙ্গে এনেছেন এক সুটকেস বই। যেগুলো তাদের এক বন্ধুর জন্য আনা। শাড়ি-গহনা, কিংবা সাংসারিক গল্পের চেয়ে বই আমাকে বেশি টানে, এটা ভাবির জানা। তিনি দয়াপরবশত আমাকে তার বেডরুমে নিয়ে গিয়ে বই ভরতি বাক্সটি আমার সামনে খুলে দিয়েছিলেন। হাভাতের সামনে ভাতের থালা ধরলে যা হয়, আমার তখন সেই দশা। হাতে সময় খুবই অল্প। কেননা, বইগুলোর মালিক পরদিনই ফিরে যাবেন তার স্টেটে। অপরিচিত বিধায় দুম করে বইটা ধার চাওয়াতেও বাধা। চটপট পড়লে বইটা শেষ করা সম্ভব। ভালো কথা, সে বইয়ের নাম, “আপনি তুমি রইলে দূরে সঙ্গ নিঃসঙ্গতা ও রথীন্দ্রনাথ”, লেখক নীলাঞ্জন বন্দোপাধ্যায়।
বইয়ের শিরোনামই যেন অনেক কিছু বলে দিচ্ছিলো– সেসব যে মর্মপীড়ার কারণ হবে ভাবিনি। বইটির কেন্দ্রে যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন না- তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথই এর কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু তার অনেকটা জুড়েই তিনি থেকে গেছেন। যেভাবে আজীবন পুত্রের জীবন বৃত্তে ছায়া ফেলেছিলেন– সেভাবেই বুঝি আপনি তুমি রইলে দূরেতেও তাঁর অস্তিত্ব বড়বেশি প্রকট। সেই আড়াল ভেঙে যতবার ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের দেখা পেয়েছি, ততবারই মনের ভেতর ব্যথা বেজেছে। প্রিয় মানুষের সামান্যতম ত্রুটিবিচ্যুতিতে মন ভারাক্রান্ত হয়– কেন জানি সহসা মেনে নিতে কষ্ট হয় তিনিও রক্ত মাংসেরই সাধারণ মানুষ– ফেরেশতা নন। ভুলত্রুটি থাকা তার জন্যও খুব স্বাভাবিক। এটা কোনোভাবেই বইটির পাঠপ্রতিক্রিয়া নয়, তাছাড়া বইটা এত দ্রুত পড়েছিলাম, পইপই করে সব মনেও নেই। এটাকে বরং এক বইয়ের ভেতর বাড়িতে বাঙালির মুখে নিরন্তর মোহিত হওয়ার মতো ভাষা গুঁজে দেওয়া এক অসাধারণ শব্দ জাদুকরকে ভিন্ন চেহারায় দেখে নেওয়ার ভ্রমণ বলা যেতে পারে। যেখানে তিনি দোষেগুণে ভরপুর এক বাবা-- যিনি বেশ খানিকটা আত্মকেন্দ্রিক- স্বার্থপর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নিজস্ব আলোয় উদ্ভাসের যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রায়শই তিনি বাবার ছায়ায় ঢাকা পড়ে ছিলেন। তাঁর জীবন যেন ছিল বাবা রবীন্দ্রনাথের চারপাশে আবর্তিত হওয়া এক গ্রহের মতো। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত শোক; স্ত্রী, সন্তান, দৌহিত্র হারানোর বেদনা তাঁকে একমাত্র পুত্র রথীন্দ্রনাথের দিকে ধাবিত করেছিল। নিঃসন্তান রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী তাঁদের জীবনের প্রায় তিন দশক উৎসর্গ করেন কবির সেবায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটি চিঠিতে এক অনুরোধ রেখেছিলেন—“আমাকে যেন অসুস্থ শিশুর মতো দেখো”, যা রথী-প্রতিমা দম্পতির জীবনের অন্যতম ব্রত হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন রথীন্দ্রনাথ স্বরূপে আবির্ভাবের যেন কোনো সুযোগ পাচ্ছিলেন না। বাবার মৃত্যুর পর, রথীন্দ্রনাথের জীবনে আসে বিরাট পরিবর্তন। লেখক হিসেবে তিনি বই প্রকাশ করেন। বিশ্বভারতীর দায়িত্বভারে সংযুক্ত হন। তার বাইরে যে বিশেষ ঘটনা বা দুর্ঘটনার কারণে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত, সেটা বাঁধভাঙা আগ্রাসী জোয়ারের মতো শুরু হয়।
সহকর্মী নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীরা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গড়ে ওঠা সম্পর্ক, বাবার প্রয়াণের পর অধিকমাত্রায় গভীর হয়ে ওঠে। সেই সম্পর্ক শান্তিনিকেতনে বিতর্কের জন্ম দেয়, ঠাকুর পরিবারে ক্ষোভের সঞ্চার করে, এবং বিশ্বভারতীর প্রশাসনিক স্তরেও আলোড়ন তোলে। শেষপর্যন্ত রথীন্দ্রনাথ পদত্যাগ করেন, মীরাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান দেরাদুনে।
দেরাদুনে রথীন্দ্রনাথ গড়ে তোলেন এক সামাজিক বলয়। যেখানে মীরার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে তিনি সামাজিক স্বীকৃতি দিতে চান। নির্মলচন্দ্র, মীরার স্বামী, এই সম্পর্ক মেনে নেন, যদিও তাঁকেও ত্যাগ করতে হয় নিজের পারিবারিক স্বস্তি। মীরার মা, নির্মলের আত্মীয়রাও এই নতুন বাস্তবতাকে মেনে নেন। অথচ স্ত্রী প্রতিমা দেবীর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়নি। তিনি অর্থ সাহায্য করেছেন, খোঁজ নিয়েছেন, কিন্তু মীরার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন। সম্পর্কগুলোর জটিল মনোস্তত্ত্ব সপাটে বুঝে ওঠা সম্ভব না হলেও এটুকু স্পষ্ট যে, ওই সময়ের বিচারে, রথী-প্রতিমা, নির্মলচন্দ্র- মীরা ছিলেন অনেক বেশি অগ্রসর চিন্তাচেতনায় ভরপুর এবং সাহসী মানুষ।
নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আপনি তুমি রইলে দূরে বইটি রথীন্দ্রনাথকে তুলে এনেছে বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে। ১২৭টি চিঠি, একটি টেলিগ্রাম, এবং বহু আলোকচিত্র দিয়ে সাজানো এই বইতে রথীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের অন্তরঙ্গতা ও দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মীরার প্রতি তাঁর দুর্বার প্রেম, প্রতিমার প্রতি অছেদ্য সহমর্মিতা, এবং বিশ্বভারতীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন, সবই এখানে ধরা পড়ে। মীরা দেবীর উদ্দেশ্যে লেখা রথীন্দ্রনাথের চিঠিগুলো পড়তে গিয়ে, ১৮১৯ সালের ১৩ অক্টোবর কবি কীটস্ এর বিখ্যাত এক প্রেমপত্রের কথা অনেক পাঠকের হয়তো মনে পড়তে পারে। সে চিঠিতে তিনি প্রেমিকা Fanny Brawne'কে লিখেছিলেন– “My Creed is Love and you are its only tenet – You have ravish’d me away by a Power I cannot resist... My Love is selfish – I cannot breathe without you... I have been astonished that Men could die Martyrs for religion – I have shudder’d at it – I shudder no more. I could be martyr’d for my Religion – Love is my religion – I could die for that – I could die for you.”
মীরা দেবীকে লেখা রথীন্দ্রনাথের চিঠিগুলোর ভাষা হুবহু একই না হলেও তাঁর লিখিত চিঠির আত্মায় কীটসের বক্তব্যেরই যেন প্রতিধ্বনি অনুরণিত হতে শোনা যায়।
রথীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলো কেটেছে দেরাদুনে, মীরার সান্নিধ্যে। তাঁর মৃত্যুর সময় মুখাগ্নি করেননি পুত্র জয়ব্রত, সে কাজ করেন ঠাকুরবাড়ির সুপ্রিয় ঠাকুর। এই নিঃশব্দ বিদায় যেন তাঁর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। নেপথ্যের এক চরিত্র, যিনি ছিলেন পিতার ছায়ায় চাপা পড়ে যাওয়া এক মানুষ।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এমন এক মহীরুহ, যার ছায়া এত গভীর যে রথীন্দ্রনাথের নিজের আলো সেখানে ছিল নিষ্প্রভ। পিতার শোক, পিতার দায়িত্ব, পিতার সেবা—সবকিছু যেন রথীন্দ্রনাথের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। তিনি ছিলেন সেই পুত্র, যিনি নিজের উচ্চশিক্ষা, নিজের পছন্দ, এমনকি নিজের দাম্পত্য জীবন পর্যন্ত পিতার ইচ্ছার ছাঁচে গড়ে তুলেছিলেন।
এই সম্পর্ক নিছক আনুগত্যের ছিল, সেটা বলা হয়তো অন্যায় হবে। রথীন্দ্রনাথ কখনো প্রকাশ্যে পিতার বিরুদ্ধে যাননি, কিন্তু তাঁর জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত–যেমন মীরার সঙ্গে সম্পর্ক, দেরাদুনে চলে যাওয়া, নিজের বই প্রকাশ করা পিতার মৃত্যুর পর—সবই যেন এক নিঃশব্দ বিদ্রোহ। তিনি চেয়েছিলেন নিজের মতো করে বাঁচতে, কিন্তু সেই চাওয়া বারবার পিতার ছায়ায় ঢেকে গেছে।
তাঁর জীবন যেন এক দীর্ঘ আত্মত্যাগের অধ্যায়, যেখানে নিজের স্বপ্ন, নিজের আকাঙ্ক্ষা, নিজের সত্তা—সবই পিতার পরিচর্যার altar-এ উৎসর্গিত।
এই সম্পর্কের সবচেয়ে করুণ দিকটা হলো-- বিদ্যা-বুদ্ধিতে রথীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন যথার্থ সজ্জন, মৃদুভাষী, সৌজন্যপরায়ণ মানুষ। কিন্তু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা কেটেছে অন্যের ছন্দে, অন্যের শৃঙ্খলায়। তিনি ছিলেন সেই কর্মী, যার নাম নেপথ্যেই থেকে গেছে, যেমন রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “কর্মের যেখানে উচ্চ দাম, সেখানে কর্মীর নাম নেপথ্যেই থাকে একপাশে।” এই নেপথ্যে থাকা মানুষটির জীবনের জটিলতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, এবং আত্মপরিচয়ের সংগ্রাম, সব মিলিয়ে রথীন্দ্রনাথ যেন হয়ে ওঠেন এক নিঃসঙ্গ নায়ক। তাঁর গল্পটা আমাদের শেখায়, কীভাবে এক মহান পিতার ছায়ায় থেকেও একজন মানুষ নিজের আলো খুঁজে ফেরে।
পাঠ শেষে মনের ভেতর কুটকুট করেছিল এমন কিছু প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঘিরে লক্ষ-কোটি ভক্ত পাঠকের মনে যে ইমেজটি রয়েছে-- তাকে আঘাত করতে এসব প্রশ্নের উল্লেখ নয়-- তিনি একজন রক্ত মাংসেরই মানুষ ছিলেন। ভুলত্রুটি তাঁর ভেতরও ছিল। এই যে তিনি পুত্র রথীন্দ্রনাথকে বিদেশে কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পাঠিয়েছিলেন-- বাস্তব ক্ষেত্রে সেই শিক্ষা প্রয়োগ যথাযথভাবে আদৌও কী ঘটেছিল? কেন ঘটেনি? তার প্রধানতম কারণ কি বাবা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না? বিশ্বভারতীর পরিচালনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের পথে হাঁটেননি-- যার ফলে তাঁর প্রস্থানের পর সেরকম যোগ্যতা দেখানোর মতো কাউকেই দেখতে পাওয়া যায়নি-- এর দায়ভার কী রবীন্দ্রনাথের নয়? কেন তিনি নেতৃত্ব তৈরির কথা চিন্তা করেননি? তাঁর মতো একজন অগ্রসর চিন্তার মানুষের তো সেটা ভেবে রাখার কথা ছিল। পুত্র এবং পুত্রবধূর ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবনের ২৯ বছরই কেটেছে বাবার সঙ্গ ধরে-- তাঁর মতো আধুনিকমনষ্ক একজন ব্যক্তি কেন এমন স্বার্থপরতা দেখিয়েছিলেন? এসব জটিল মনোস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো উত্তর বিহীন হয়ে থেকে গেছে।
এই বই পাঠক হিসেবে আমাকে বুঝি এমন এক দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল--যেটা খুলেই সপাটে দেখে ফেলতে হয় প্রিয় এক জাদুকরের অন্তরজগৎ। যেখানে তিনি অনন্য, অসাধারণ কোনো স্রষ্টা নন। নন শত কোটি বাঙালির অন্তরে নিত্য আসা-যাওয়া করা আরাধ্য ঠাকুর-- বরং এমন এক মানুষ, যাঁর আচরণের (অ)করুণ প্রকাশ বড় বেদনার মতো বাজে।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন