'সখী, ভালোবাসা কারে কয়!'







তুমি ভাবো মানুষ হয়ে জন্ম নেওয়াটা আশীর্বাদ বিশেষ। কেননা মানুষ তার অনুভূতি নানা অভিব্যক্তির ভেতর দিয়ে প্রকাশ করতে সক্ষম। অন্য জীব বা প্রাণীরা সেটা পারে না। গাছেরা তাদের অভিমান কিংবা ভালোবাসা প্রকাশ করতে জানলে নাকি বনরাজি জুড়ে তৈরি হতো অসংখ্য পাতার বই– তাতে লেখা থাকতো থরে থরে কবিতা-গল্পকথা। আমি তো বলি গাছেরা ঠিকই তাদের অভিমান কিংবা ভালোবাসা প্রকাশ করতে জানে। আমরা তাদের ভাষা জানি না বলে হয়তো বুঝতে পারি না। গাছের প্রাণ আছে, এমন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে জগদীশ চন্দ্র বসু হয়তো গাছেদের কথা-তাদের ব্যথার হদিশও পেয়েছিলেন- কে জানে! তবে আমার কী মনে হয় জানো? গাছেরাও তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে– ভাবো তো একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের কথা– থোক থোক লাল বুঝি তার আরক্ত মনের প্রকাশ নয়! সে হয়তো অভিমানে কিংবা আত্মদহনে অথবা ভালোবাসায় রাঙিয়ে ওঠা। ফুলে ফুলে ভরে ওঠা গাছেরা কী ওদের আনন্দের আভাস দেয় না! এটা সত্যি, মানুষের মতো ভাষায় প্রকাশের ক্ষমতা ওদের নেই।

মানুষ তার রাগ, অভিমান, ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা সপাটে প্রকাশ করতে জানে। এর মধ্যে নিঃসন্দেহ শুভতর প্রকাশের নাম ভালোবাসা। পৃথিবী সৃষ্টির হাজার কোটি বছর পেরিয়ে গেলেও ভালোবাসা-প্রেম শব্দগুলো আজও বহুব্যবহারে তামাদি হয়ে যায়নি। পৃথিবীর নানাপ্রান্তে প্রতিনিয়ত এই পার্থিব শব্দের অপার্থিব বিনিয়োগ ঘটে চলেছে বলেই পৃথিবী আজও ছন্দ হারায়নি। মানুষ আজও বেঁচে থাকার আশা হাত গ’লে পড়তে দেয়নি। হ্যাঁ এককথা সত্যি, পৃথিবীর কোথাও ঠিক এই মূহূর্তে, একদল মানুষ ভালোবাসার পরিবর্তে ঘৃণা ছড়াচ্ছে– যুদ্ধ নামের হিংসাত্মক কৌশল গ্রহণ করে শত শত মানুষের জীবন সংহার করে নিজের ক্ষমতার দেখনদারিতে মত্ত।

স্বার্থপরের মতো শোনালেও তাতেও কিন্তু ভালোবাসার পাট পৃথিবী থেকে উঠে যায় না; যাবে না। যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন ভালোবাসা নামের অনুভূতির চর্চাও চলমান থাকবে। হয়তো এমন দিন আসবে যখন ভালোবাসার অনুভূতি সম্পন্ন বিপুল সংখ্যক মানুষ যুদ্ধ-হিংসাত্মক কূটকৌশলের দেউলিয়াত্ব ঘোষণা করবে। সেদিনটা হয়তো আদৌও কখনও আসবে না– কিন্তু যে অলীক কল্পনা আমাদের নিউরনে শুভবোধ ছড়িয়ে দেয় সেরকম ভাবনায় মন ভোলাতে কারো কোনো ক্ষতি তো নেই- তাই না!

কথা শুরু করেছিলাম মানুষের অনুভূতি নিয়ে- মানুষ ভালোবাসতে জানে- জানে তার প্রকাশ ঘটাতে। খুব সম্ভবত তখন নবম কী দশম শ্রেণিতে পড়ি– সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বই পড়েছিলাম, নাম “ভালোবাসা প্রেম নয়”। বইটার বিষয়বস্তু অতটা মনে না থাকলেও শিরোনামখানা মনে গেঁথে গিয়েছিল। তার অর্থটা নিয়ে মনে একধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল– ভালোবাসা প্রেম নয় তবে কী? সময় গড়িয়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বয়স। নানা পঠনপাঠনের অভিজ্ঞতায় সে দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত ভাসান ঘটেছে- এমন কথা বুকে কিল মেরে বলা যাচ্ছে না। বাংলাদে্শের স্বনামখ্যাত লেখক হুমায়ূন আহমেদ প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে প্রচুর লিখেছেন। তাঁর অধিকাংশ বইতেই ভালোবাসার লিলুয়া বাতাসের মাতামাতিতে লক্ষ পাঠকের মন আন্দোলিত হয়/হয়েছে। অধিকাংশ চরিত্রই মনের ভেতর ভালোবাসার ছোট্টখাট্ট একটা সরোবর বয়ে বেড়াতে উস্তাদ। অথচ তারপরও আমাদের সমাজ জুড়ে প্রকৃত ভালোবাসার কত অভাব। ঠিক যেন শেখের বেটির মতো দশা– শত শত মাদ্রাসা-মসজিদ তৈরি করেও তিনি যেমন ব্যর্থ প্রকৃত মানুষ তৈরিতে...লক্ষ-কোটি ভালোবাসাবাসির লেখালিখিও পারেনি পশুবৃত্তির নাশ ঘটিয়ে সমাজটাকে ভালোবাসার সচলায়তন হিসেবে দাঁড় করাতে। এই মরেছে! ভালোবাসার ভেতর রাজনীতি ঢুকে পড়ছে। সেটি হতে দেওয়া যাবে না–এই কথোপকথন স্রেফ ভালোবাসা-প্রেম নিয়ে। বলছিলাম জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের কথা। তিনিও ভালোবাসা আর প্রেমের ভেতর একটা লক্ষণরেখা টেনে দিয়ে বলেছেন -

"পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালোবাসার অত্যাচার হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ানক। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনও কিছু বলা যায় না, শুধু সহ্য করে নিতে হয়।"

আর প্রেম নিয়ে বলেছেন-

"প্রেমে পড়া মানে নির্ভরশীল হয়ে পড়া। তুমি যার প্রেমে পড়বে সে তোমার জগতের একটা অংশের দখল নেবে। যদি কোনো কারণে সে তোমাকে ছেড়ে চলে যায়, তবে সে তোমার জগতের ঐ অংশটুকুও নিয়ে যাবে। তুমি হয়ে পড়বে শূন্য জগতের বাসিন্দা।"

তার মানে কী এই দাঁড়ালো, ভালোবাসার চেয়ে প্রেমের শেকড় আরো গভীরে? আবার অনেককে বলতে শুনি, প্রেমের ব্যাপারটা নাকি নিয়ন্ত্রিত, অন্যদিকে ভালোবাসার সীমা অনেক বিস্তৃত। ভালোবাসার অনুভূতি একপক্ষের ভেতর তৈরি হতে পারে, অন্যপক্ষ ভালো না বাসলেও তাতে খুব যায় আসে না। অন্যদিকে প্রেম হবে দুইপক্ষের। দ্বিপাক্ষিক সম্মতি বিনা এই অনুভূতির শতফুল হয়ে ফোটার কোনো চান্স নেই। ভালোবাসায় জাতপাতের বালাই থাকে না। প্রেমের ক্ষেত্রেও তাই বলা হয়ে থাকে। যদিও আধুনা “প্রেম করতে একদিন, ভাঙতে দুই দিন…”

বাংলা ভাষায় যেমন ভালোবাসা বা প্রেম, ইংরেজি বা অন্য ভাষাতেও এর রকমফের রয়েছে। ইংরেজিতে love সবচেয়ে সাধারণ ও বহুল ব্যবহৃত শব্দ। কিন্তু এর বাইরেও অনেক শব্দ ও অভিব্যক্তি আছে, যেমন: Affection -মমতা বা গভীর স্নেহ। Passion-আবেগপূর্ণ ভালোবাসা বা কামনা। Infatuation -আকস্মিক বা মোহময় প্রেমের ঘোরে পড়া। Crush-ক্ষণস্থায়ী কিন্তু জোরদার প্রেমানুভূতি। Romance-রোমান্টিক প্রেম। Adoration-উপাসনা পর্যায়ের ভালোবাসা। Devotion -নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। Lust-কামনা, যা শুধু শারীরিক আকর্ষণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। Amour-(ফরাসি উৎসের শব্দ) সাধারণত একটু নাটকীয় বা  সঙ্গোপনের প্রেম বোঝাতে এটা ব্যবহৃত হয়। Love affair শব্দটা সাধারণত এমন একটি সম্পর্ক বোঝাতে ব্যবহৃত হয় যা হয়তো গোপন বা সামাজিকভাবে অনুমোদিত নয়। তবে সব love মানেই affair নয়।

প্রতিটা ভাষায় প্রেমের অনুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য একেক রকম রং, স্বর এবং শব্দ আছে। একটা চমৎকার ভিডিও দেখেছি কিছু আগে। হিন্দিভাষী সুবক্তা আশীষ বাগরেচা(Ashish Bagrecha) নামের এক ভদ্রলোক এ বিষয়ে চমৎকার করে বলেছেন। বাংলায় যেমন ভালোবাসা আর প্রেম, হিন্দি ভাষায় অনুভূতির চিরন্তন এই স্তর তিনটে ভাগে গড়িয়েছে। বোঝার সুবিধার জন্য আমি মনে মনে সেটাকে ইংরেজি গুড-বেটার বেস্ট এই তিন ক্যাটাগড়ি হিসেবে ভেবে নিয়েছি। তাঁর বয়ান জানা যাক:

পেয়ার- একে একধরনের চাওয়া বলতে পারি। সেটা হতে পারে কোনো বস্তুর প্রতি, কোনো জায়গার প্রতি কিংবা কোনো মানুষের প্রতি। এই জায়গাটা আমার পছন্দ- এই জায়গার প্রতি আমি অনুরক্ত-- অমুকের প্রতি আমি অনুরক্ত ইত্যাদি ইত্যাদি-- এই চাওয়া উঠে আসে মনের ভেতর থেকে। কোনো এক বস্তু-জায়গা বা ব্যক্তিকে নিয়ে কারো অনুভূতি হয়তো অনুরণন তোলে, তাকে/ওই জায়গা/ অমুক জিনিসটা আমার খুব পেয়ারের ...

মোহাব্বত- হৃদয় থেকে আসে এর অনুভূতি। চাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে টপকে আগে বাড়ে এমন অনুভূতি। হৃদয়ে ওঠে নিবিড় এক শোরগোল, বিশেষ কারো জন্য-- সেটাই মোহাব্বত। একে ঘিরে হৃদয়পুরে কখনও ঝড় ওঠে-- কখনও হয় নিঃশব্দ ক্ষরণ। আলোড়ন আর প্যাসনের নানাস্তর ঘিরে থাকে এই অনুভূতি।

ইশক- মোহাব্বতের স্তর পেরিয়ে যার উদয় ঘটে, তার নাম ইশক্। ইশক্- এর সম্পর্ক রুহের সঙ্গে। ইশক ইবাদত-- সেটা সৃষ্টিকর্তার প্রতি হতে পারে-- কিংবা কোনো বিশেষ মানুষের প্রতি হতে পারে। যার অভিঘাতে একজন হয়ে উঠতে পারে পাগলপ্রায়। কপিলাবস্তুর রাজকুমার সিদ্ধার্থের রুহ ছুঁয়েছিল ঈশ্বরের প্রতি জন্ম নেওয়া ইশক নামের গভীর অনুভূতি- যার টানে তিনি বস্তুগত মোহ ছেড়ে নির্বাণের পথে হেঁটে গিয়েছিলেন। মীরা বাঈয়ের রুহকেও ছুঁয়েছিল এই ইশক। রাজপরিবারে জন্ম, কিন্তু কৃষ্ণপ্রেমে এমন নিমগ্ন হয়েছিলেন যে সংসার, রাজনীতি, সামাজিক প্রথা, সবকিছুকে তুচ্ছ মনে করে তিনি সন্ত বনে যান। হয়ে ওঠেন এক ভ্রাম্যমাণ ভক্ত। তাঁর পদাবলীতে হৃদয়ের সেই ব্যাকুলতা স্পষ্ট: "পায়েলিয়া ঝনকার রে, মোরো পিয়া ঘর আয়ো..." এই ইশক যেন কোনো মানুষের প্রতি নয়। এ এক আধ্যাত্মিক বিরহ ও মিলনের অনন্ত আরাধনা। লাইলি-মজনুকেও সেই একই পথের পথিক বলা যায়।

ক্ষ্যাপার পরশ পাথর খুঁজে ফেরার সঙ্গে ইশকের কোনো সম্পর্ক আছে কি না আমার জানা নেই। আসলে এ এমন এক অনুভূতি, যা পার্থিব জগত ভুলিয়ে দেয়-- তাই ইশককে রুহানি বলা হয়।

আমি অতি সাধারণ মানুষ, রুহানি ভালোবাসার বিন্দুবিসর্গ জানা নেই। ভালোবাসার নির্ভুল সংজ্ঞা বলে কি আদৌও কিছু হয়? দিবসও রজনী "ভালোবাসা ভালোবাসা" বলে হেঁদিয়ে মরা মন কী জানতে পারে তার সঠিক সংজ্ঞা! নির্ভূল সংজ্ঞায় পৌঁছাতে না পারলেও চোখ বুঁজে একথা বলা যায়, ভালোবাসা কেবলই যাতনাময় হয় না– সেটা হলে তার জন্য আমাদের মন এত হন্য হতো না। আর সেটা নয় বলেই আমাদের মন শেষমেশ কিন্তু "ভালোবাসি ভালোবাসি"– বলতেই ভালোবাসে। ‘If I were a Yogi, love would be like the holy Ganga to me.’এমন ভাবনা যে মগ্ন চৈতন্যে শিস হয়ে বেজে যায়; সেই মন আকুল হয়ে বলে ওঠে– 

"আমার কথা গাছের মতন পুতে
তোমাকে তার ছায়ায় রেখে যাবো"

ভালোবাসা-প্রেম, পেয়ার-মোহাব্বত-ইশক্-লাভ, যে নামেই ডাকি না, এ এমনই এক অপার্থিব মায়াবী গাছ, যে কেবলি লাবণ্য ধরে রাখে। যার ছায়া পেতে আমরা সবাই মুখিয়ে থাকি।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাদ যাবে কি মুজিব(বাদ!)?

শান্তির ছদ্মবেশে কি স্বাধীনতাহরণ?