আমাদের সত্যিই সর্বনাশ হয়ে গেছে



ত কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের হিংস্রতার দৃশ্য আমাদের অনেকেই হতবাক করে রেখেছে। কেমন যেন মূক-বধির হয়ে গেছি। মনে হচ্ছে ভেতরের ইতিবাচক শক্তি যেন নিঃশেষ। এমন অসুস্থ পরিবেশে একটা জাতি কীভাবে বেঁচেবর্তে থাকে ভেবে বিস্মিত কম হচ্ছি না। ব্যথিত হচ্ছি সেইসব শিশুদের কথা ভেবে, যারা অসুস্থ, হিংসায় উন্মত্ত ওই পরিবেশের ভেতর আছে। কী শিখছে বা শিখবে ওরা আজকের বাংলাদেশে চলমান তাণ্ডব থেকে? ওদের মননে রাষ্ট্র-সমাজ এবং পরিবার যেন সযত্নে বুনে দিচ্ছে হানাহানির সংস্কৃতি। পর মতের প্রতি হিংসাত্মক আচরণের কলাকৌশল। আজ ওরা দেশজুড়ে যা দেখছে শুনছে– বিশেষ করে সাত বছর বয়সি আয়েশা নামের ছোট্ট শিশুটিকে বন্ধ ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করার যে ঘটনা-- কী পাশবিক! কিংবা দীপুচন্দ্র দাস নামে একজন কর্মীকে প্রথমে মেরে হাত-পা ভেঙে তারপর গাছের সঙ্গে বেঁধে পুড়িয়ে হত্যার- এই যে নারকীয় উদাহরণ রাখা হলো– এবং আশ্চর্যের কথা এসব নিয়ে রাষ্ট্র নীরব থাকলো, সুশীল সমাজ নীরব থাকলো। এসব কী শিশু মননে প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে না? প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী মবচক্রের ক্ষমতা প্রদর্শনের এই মারণ নেশা যে আজকে যারা শিশু তাদের কাউকে আগামীর মব হতে প্ররোচিত করবে না- সেটা আমরা হলফ করে বলতে পারি? তার জন্য তার পরিবার যতটা দায়ী থাকবে তারচেয়ে অনেক বেশি দায়ী থাকবে রাষ্ট্রের নীরবতা, বিচারহীনতা আর মবের প্রতি তার পৃষ্ঠপোষকতার নির্লজ্জতা।

কেন মরতে হলো ময়মনসিংহের দীপুচন্দ্র কে? তিনি যেহেতু সংখ্যালঘু, কাজেই তার ওপর প্রথমে ধর্ম অবমাননার সেই চিরাচরিত ট্যাগটাই লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আদতে ঘটনা মোটেও তা ছিল না। কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে জীবন দিতে হয়েছে। কত সস্তা না একজন মানুষের জীবন! তার ওপর সংখ্যালঘু হলে তো সেটা রীতিমত জায়েজ আজকাল। শুধু তাই নয়, হত্যার সেই দৃশ্য রীতিমত উৎসবের মেজাজে সমবেত জনতা ফোনবন্দিতে মেতে ওঠার ঘটনা ভয়াবহই শুধু নয়– মানুষ হিসেবে কতটা নির্মম আর লজ্জার- সেটা বোঝেন ক্ষমতায় যারা বসে আছেন তাবড় তাবড় ডিগ্রিধারী লোকজন তারা? তাদের নিশ্চুপ থাকা কী প্রমাণ করে আসলে? ঘটনা সম্পর্কে তারা বিন্দুমাত্রও জানতে পারেননি? ঘটনার কতদিন পর তারা সামান্য নড়েচড়ে বসেছেন? বিদেশি হর্তাকর্তার চোখ রাঙানি, মিডিয়ার সরবতা এবং দেশিও ক্ষমতালোভীদের হিসাবনিকাশে যখন বুঝেছেন দায় তাদের ঘাড়ে বর্তাবে তখন সামান্য হেলদোল হয়েছে তার আগে নয়। প্রবাদ সত্যি হতে দেখা গেল আরো একবার- যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ। বাংলাদেশের জন্য আফসোস, আজকে গোটা বাংলাদেশটাই সেই রাবণের পালের হাতে পড়ে গেছে। তাই তাকে বার বার রক্তাক্ত হতে হচ্ছে। অগ্নিসংযোগে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ছায়ানটের মতো ঐতিহ্যবাহী একটি সাংস্কৃতিক ভবন। কেন?

এক জঙ্গীমনার মৃত্যুর সঙ্গে ছায়ানটের সম্পর্ক কী? তাদের অপরাধই বা কী? হামলাকারীদের যুক্তি: ছায়ানট সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের বাহক, ভারতীয় আধিপত্যবাদের অংশ। ফ্যাসিবাদী আচরণের নজির হিসেবে ইতিহাস কী সাক্ষ্য দেয়? ফ্যাসিবাদ সবসময় প্রথম আঘাত হানে সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ওপর। কারণ সংস্কৃতি মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়, আর ফ্যাসিবাদ প্রশ্ন সহ্য করতে পারে না। ছায়ানট বাংলাদেশের স্বাধীনতাসহ যাবতীয় অর্জনকে ধারণ করে এবং মুক্তচিন্তার আলো ছড়ায়- দোষ এটাই। তাই তাকে ধ্বংস করতে হবে। যেভাবে বার বার ধানমন্ডি ৩২ এর ওপর চড়াও হয়ে মবগোষ্ঠী তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। তাদের পূর্বপুরুষদের পরাজয়ের শোধ তুলতে চায়। ক্ষোভ ভুলতে চায়। ইতিহাসের মীমাংসিত সত্যিকে চিরতরে মুছে ফেলতেই বাংলাদেশকে বার বার মবগোষ্ঠা রক্তাক্ত করতে চায়।

কালচারাল ফ্যাসিজম জন্ম নেয় কখন? যখন বহুত্বের কথা বলা হলেও রাজনৈতিক প্রকল্পের বাইরে থাকা সব সাংস্কৃতিক ধারাকে ‘শত্রু’, ‘বিদেশি’, বা ‘এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ছায়ানটের মতো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেলিজিটিমাইজ করার সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার ফলাফল হলো সেখানে মবের সন্ত্রাস চালানো। “ভারতীয় এজেন্ট”, “লীগের দালাল”, “এলিটিস্ট”এই লেবেলগুলো ব্যবহার করা হয় যাতে মানুষ সংস্কৃতির শুদ্ধতার নামে এসব প্রতিষ্ঠানকে বর্জন করে।

ভারতীয় আধিপত্যবাদের বয়ান এখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কৌশলে। ভারতীয় আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠুক সমস্যা নেই– আজকে যিনি আইন উপদেষ্টা– তার বহু বিখ্যাত একটি বুলি ছিল ভারতীয় আধিপত্য নিয়ে– যে লাখ লাখ ভারতীয়রা বাংলাদেশের চাকরির বাজার দখল করে আছে। তার মতো মানসিকতার লোকজন বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলেছেন– ভারতের কাছে বাংলাদেশ বিক্রি হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টেরা একজনও তার প্রমাণ দাখিলে সক্ষম হয়েছেন কি? দেখাতে পেরেছেন লক্ষ কর্মীদের মধ্য থেকে একশ জনকে? নিদের পক্ষে জনা পঞ্চাশেক? কিংবা দেশ বিক্রির দলিলদস্তাবেজ? না– পারেননি। যেটা হয়নি তার প্রমাণ দেওয়া তো সম্ভব না। যেটা সম্ভব- সেটা হলো গুজব রটিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল। দেশে বর্তমানে ভারত বিদ্বেষের যে বাম্পার ফলন, সেটা তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলেরই কৌশল মাত্র।

অতি দুঃখের ভেতরও মবগোষ্ঠী এক কৌতুককর দৃষ্টান্ত রেখেছে। সেটা কি? তাদের হটকারীতা থেকে সহযোগী বন্ধু শ্রেণিও রক্ষা পায়নি। এটি কি তাদের মেটিকুলাস ডিজাইনের আওতাভুক্ত নতুন কোনো কৌশল কি না বোঝা মুশকিল। কিন্তু প্রথম আলো, ডেইলি স্টারের মালিকপক্ষেরা তো নিরাপদেই ছিলেন, আছেন থাকবেন। মবগোষ্ঠীর ফ্রেন্ডলি ফায়ারের আঁচে পড়ে ভুগতে হয়েছে নিরীহ বিপুল সংখ্যক সংবাদকর্মীকে।

জীবিত মানুষের কাছে তার জীবন বড় আদরের- বড় মায়ায় জড়ানো। সেই জীবন হুমকীর মুখে পড়বার যে অযাচিত অভিজ্ঞতা আগুনের ভেতর আটকে পড়া সাংবাদিকেরা অর্জন করেছেন- বাকি জীবন হয়তো তাদের ঘটনাটা তাড়িয়ে বেড়াবে। প্রথম আলো আর ডেলি স্টারের আগুনে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ভাবিত নই। তারা লাভের গুড় ঠিকই বুঝে পাবেন- নো ওরিজ। আমি ভাবছি দীপুচন্দ্রের সংসারের কথা। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে কীভাবে চলবেন? তাঁর ছোট্ট শিশু সন্তানটিকে বাবার স্নেহ ভালোবাসাহীন হয়ে কাটাতে হবে। আয়েশার পরিবারই বা তার শূন্যতার ব্যথাভার কোন প্রাণে বয়ে বেড়াবেন? ছায়ানটের যে বিপুল সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হলো– ওরাই বা ওদের ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন? আয়েশা নামের ছোট্ট শিশুটিকে যারা পুড়িয়ে মারলো - কেন মারলো? যতটুকু জেনেছি, শিশুটির বাবা মবগোষ্ঠীর বিপরীত রাজনৈতিক দলের সদস্য। বাহ্ চমৎকার! তার জন্য এরকম নারকীয় কায়দায় তার সন্তানকে হত্যা করতে হবে??

এসব তাণ্ডবের দায়ভার কার? প্রধান উপদেষ্টা কি অন্ধ না কি বধির? তার কি কানে যায়নি তারই আশকারায় দানবে রূপান্তরিত তার মবগেোষ্ঠীর নারকীয় হুঙ্কার? ভারত বিদ্বেষের নামে দেশটাকে রণক্ষেত্রে পরিণত করলে কাদের লাভ? বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে এরই মধ্যে আমাদের সাড়ে সর্বনাশ ঘটানো হয়ে গেছে। দেশে অধিকাংশ মানুষই বুঝি এমন এক হতবিহ্বল বাবলের ভেতর বসবাস করছেন- যেন বুঝেও বুঝতে সক্ষম নন- আমাদের সত্যিই সর্বনাশ হয়ে গেছে। আয়রনি হলো, সেটি ঘটিয়েছেন একজন নোবেল শান্তি(যৌথভাবে) পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তি!

Photo credit: Jeff Gauger

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাদ যাবে কি মুজিব(বাদ!)?

বড় বেদনার মতো বাজে...

শান্তির ছদ্মবেশে কি স্বাধীনতাহরণ?