শান্ত স্বরে বলে যাওয়া শক্তিশালী এক আখ্যান
হিউম্যানস ইন দ্য লুপ’ সিনেমাটি শুধু নানাস্তরী নয়, এর ভেতর মুখ গুঁজে আছে এক ধরনের নীরব ক্ষমতায়নের ইশারা। প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডেটা লেবেলিং নিয়ে কথা বলা হলেও, এর মূল বিষয়বস্তু মানুষ। মানুষের জন্যই তো প্রযুক্তি–নাকি প্রযুক্তির জন্য মানুষ? এমন ভাবনাও বুঝি উসকে দেয় হিউম্যানস ইন দ্য লুপ।
এ গল্পের কেন্দ্রে আছে নেহমা নামে একজন আদিবাসী নারী, গল্পটা মূলত তাকে ঘিরেই এগিয়েছে। নেহমা ওরাঁও জনগোষ্ঠীর সদস্য, বিবাহবিচ্ছেদের পর সে দুই সন্তান নিয়ে জন্মগ্রাম ঝাড়খণ্ডে ফিরে আসে। সেখানেই সে চেষ্টাচরিত্র করে এআই ডেটা লেবেলার হিসেবে কাজ জোটায়। এরপর শুরু হয় মনদুয়ারে কড়া নাড়ার মতো এ কাহিনির মূলযাত্রা। যার গভীরে ধীর লয়ে কথা বলে যায় তাদের পারস্পারিক সহনশীলতা, নারীর মাতৃত্ব, এবং প্রাচীন জ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির সাংঘর্ষিক ও সহাবস্থানের গল্প।
নেহমার চরিত্রে অভিনয়শিল্পী সোনাল মধুশঙ্কর, সংযত অথচ গভীর অভিনয় চলচ্চিত্রের শান্ত অথচ ঋজু লয়ের সঙ্গে আগাগোড়া দারুণ সঙ্গত করে গেছে। নেহমার চরিত্রটিকে দুটি ভিন্ন জগৎকে সামলানোর দায়িত্ব পালন করতে হয়—একটি তার পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া কৃষ্টি ও বনভূমির ঐতিহ্য গাঁথা, আর অন্যটি একটি পর্দার ভেতরের আধুনিক প্রযুক্তির জগৎ। যেখানে কোড আর যন্ত্রের যুক্তি রাজত্ব করে। ডেটা লেবেলিংয়ের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তির ‘বরপুত্র খ্যাত এআইকে’ শেখানোর কাজ নেহমারের, যার শিক্ষাগত যোগ্যতার দৌড় তেমন জোরদার নয়। শিশুকে যেমন গড়েপিটে নেয় মা– সেভাবে যন্ত্রকেও সে শেখায় লেবেলিং-এর মাধ্যমে। কাজ করতে করতে একটা সময় সে বুঝতে শুরু করে, যে প্রযুক্তিটি সে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে, সেটি সেই একই পক্ষপাত শিখছে, যার খেসারত তার সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে ভোগ করেছে। সে তার ম্যানেজারকে জানায়, “এআই একটা শিশুর মতো। যদি ভুল শেখানো হয়, তাহলে ভুলটাই শিখবে।” নেহমারের এই কথাগুলো সিনেমা শেষেও আমাদের আলোড়িত করতে থাকে। অন্ধ বিশ্বাসে এআই নামের যে প্রযুক্তির হাত আমরা ধরেছি, আদৌও কি তাকে সর্বস্তরে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা হচ্ছে!
অরণ্য সাহায়ের লেখা ও পরিচালনায় নির্মিত হিউম্যানস ইন দ্য লুপের বিশেষত্ব হলো, এতে উপস্থাপিত বিষয়গুলো অত্যন্ত যত্ন এবং ধীরস্থির স্বরে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এআই, পক্ষপাত, অদৃশ্য শ্রম, লিঙ্গ, অভিবাসন, এবং আদিবাসী শিক্ষা-সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়া—সবই এখানে উঠে এসেছে, কিন্তু সেটা খুব উচ্চকিতভাবে বা গলা তুলে সেলুলয়ডে উপস্থিত হয়নি। নানাস্তরী গল্পের মাত্র সোয়া একঘন্টার চলচ্চিত্র এটি। যা শুধু আমাদের মনেই না আগামীর জন্যও ভাবনার রেশ রেখে যায়। এই সিনেমার বিশেষ কিছু মুহূর্ত মনে রাখার মতো করে উপস্থাপন করেছেন অরণ্য। যার একটি–যেখানে আমরা দেখতে পাই–এক মুহূর্তে নেহমা তার মেয়ে ধানুর সঙ্গে মাটির নিচে মিষ্টি আলু খুঁড়তে খুঁড়তে লোকগান গাইছে, আবার পরের দৃশ্যে সে কম্পিউটারের পর্দায় তাকিয়ে ডেটা লেবেলিংয়ের কাজ করছে, যা কিনা অন্য একজন মানুষকে কীভাবে বিচার করা হবে সেটা নির্ধারণ করবে। এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রতিটি উন্নত” প্রযুক্তির পেছনে আছে মানুষের শ্রম—যা প্রায়শই অদৃশ্য, কম মূল্যায়িত, এবং উপেক্ষিত।
গল্পে মা-মেয়ের সম্পর্ককে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। শহরে বড় হওয়া ধানু, হঠাৎ করে ঝাড়খণ্ডের গ্রামীণ জীবনে মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ওয়াই-ফাই বিচ্ছিন্ন হয়ে কেমন ফাঁপযে পড়ে যায়। শুরুতে সে তার মায়ের অচেনা জগৎটাকে বিন্দুমাত্রও পছন্দ করেনি। কিন্তু মালতি নামের স্থানীয় মেয়েটির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার পর তার মধ্যে বদল আসে। মালতি তাকে গ্রামীণ জীবনের ছন্দ আর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পরিচিত করায়; ফলে ধানু ধীরে ধীরে চারপাশের সরল জীবনের সৌন্দর্য দেখার দৃষ্টি প্রাপ্ত হয়। একটি দৃশ্যে মালতি একটা গাছকে জড়িয়ে ধরে যখন বলে, “এটা আমাদের পূর্বপুরুষের বুনে যাওয়া গাছ।” সেই মুহূর্তটা কাহিনির অন্তর আত্মাতেই শুধু অনুরণন তোলেনি, দর্শকের মনকেও স্পর্শ করেছে বলে বিশ্বাস। আবার আরেকটা দৃশ্যে গুহার গায়ে পূর্বপুরুষদের আঁকাআঁকিতে পরম মমতায় হাত বুলাতে থাকার ক্ষণটি মনে করা যায়– বিটুইন দ্য লাইনে অরণ্য কী মুনশিয়ানাতেই না বলতে থাকেন—প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের গভীর সম্পর্কের পাঁচালি; যা প্রযুক্তি কখনোই অনুকরণ করতে সক্ষম হবে না।
এআই এবং মানুষ এই কাহিনির কেন্দ্রে, তারপরও সামান্য একটা চরিত্র আছে গল্পে-- যা একটা আপাত নিরীহ সজারু’র। সজারুটি সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থিত। ও যেন শুধু একটা সামান্য প্রাণী নয়, বরং যেন নেহমারের প্রতিচ্ছবি। যা প্রকৃতির সঙ্গে নেহমারের গভীর বন্ধন এবং তার নীরব, সহনশীল সত্তাকে প্রতিফলিত করে।
২০২২ সালে ফিফটিটু ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সাংবাদিক করিশমা মেহরোত্রার প্রবন্ধ 'হিউম্যান টাচ্' থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে অরণ্য সাহায় এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। যেটি উৎসর্গ করা হয়েছে ঝাড়খণ্ডের সংগ্রামী নারীদের এবং আড়ালে থাকা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ ডেটা লেবেলারদের। ‘হিউম্যানস ইন দ্য লুপ’ অরণ্য সাহায়ের দারুণ মানবিক একটা নির্মাণ–যার ভিত্তিমূলে আছে উন্নয়য়নের মূল্য আর সহানুভূতির শক্তির বার্তা। যে বার্তা খুব চেঁচিয়ে বা হাঁকডাক করে বলার ঝোঁক ছিল না কোথাও। বরং ধীরস্বরে প্রায় কানে কানে বলে যাওয়ার মতো এক নির্মাণ ‘হিউম্যানস ইন দ্য লুপ’। এমন শান্ত কণ্ঠে বলা শক্তিশালী এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত সকল কলাকুশলীর প্রতি রইল আন্তরিক ধন্যবাদ ভালোবাসা।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন