তোমার আনন্দে আমার জেগে ওঠা

 


দ্য নোবেলপ্রাপ্ত লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে নিয়ে সাহিত্য জগতের মাতামাতি এখনও সম্ভবত থিতিয়ে যায়নি। তাঁর সাহিত্য নিয়ে চারপাশের আলোচনা থেকে অনেক তথ্য জানা গেছে। ২০১৫ সালে ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশন্যাল পুস্কারের ছুতোয় তাঁর নাম শোনার সুযোগ হয়েছিল। সে পর্যন্তই। ক্রাসনাহোরকাইয়ের লেখাপত্র পাঠের নিবিড় সুযোগ এখন পর্যন্ত হয়নি। নোবেল সাহিত্যের সুবাদে আবারও তাঁর নাম শোনার সুযোগ ঘটেছে। বলাইবাহুল্য, এবার তাঁকে নিয়ে আলোচনার ব্যাপ্তি অনেক বেশি- এবং সেটা স্বাভাবিক। চারপাশের আলোচনা থেকে এমনটাই আঁচ করা যাচ্ছে, তিনি তাঁর যোগ্যতার স্বীকৃতি পেয়েছেন। আমরা যে যতই পুরস্কার বিরোধী হই না কেন-- যোগ্য কেউ তাঁর কাজের যথাযথ স্বীকৃতি পাচ্ছেন, সেটা প্রত্যক্ষ করা যথেষ্ট আনন্দের। সেই আনন্দ নিয়ে ২০২৫-এর নোবেল প্রাপ্ত সাহিত্যিক লাসলো ক্রাসনাহোরকাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।

 না, আপাতত তাঁর সাহিত্য পাঠের কোনো পরিকল্পনা নেই-- তবে সাহিত্য জগত থেকে অন্য কোথাও আমার মনোযোগের বিনিয়োগ ঘটতে চলেছে, এমনটাও নয়। ঘুরেফিরে এই বৃত্তে থিতু হয়ে স্বস্তি পাই। লেখক হিসেবে লেখার মান নিয়ে পাঠক ভালো বলতে পারবেন। পাঠক হিসেবে আমি মধ্যম মানের। খুববেশি পঠনপাঠন কোনোকালেই করিনি। বুড়ো বয়স এবং ক্ষীণদৃষ্টি নিয়ে আর কতটা পাঠ করা সম্ভব। সে যাইহোক, বরং বর্তমানে দুজন বাঙালি লেখকের লেখাজোখা নিয়ে বেশ আহ্লাদে ভাসছি। তার মধ্যে একজন পরিচিত এবং পছন্দের লেখক, অন্যজন এক বাঙালি ললনা, এঁর লেখাজোখা আগে পড়বার সুযোগ হয়নি। মাত্রই আরেক হাফ বাঙালি ললনার বিশাল একটা বই শেষ করে উঠতে না উঠতে আরেক বাঙালির সাক্ষাত ঘটে গেল। ভেবেছিলাম 'ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো' বলে আগ্রহের কাছে মিনতি ঠুকে খানিক বিশ্রাম নেবো। কিন্তু সে আর হলো কই!  মনকে প্রশ্ন করেছিলাম-- আচ্ছা এই লেখক যদি বাঙালি না হতেন, ওকে জানার এতটা আগ্রহ তৈরি হতো? সম্ভবত না। এক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির বদনাম দেওয়াই যায়-- তাতেও টলানো যাবে না বাবা! বাঙালি বলে কথা। বাঙালি হয়ে অন্য বাঙালির বিজয়ান্দে নেচে না উঠলে চলে না কি! 

কোন বাঙালিকে নিয়ে কথা হচ্ছে? কেনই বা এমন আহ্লাদে ভাসছি। তিনি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন বলে নয়; তাঁর লেখা নিউ ইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার হয়েছে বলেও নয়-- আহ্লাদ-আগ্রহ যেটাই বলি না কেন, সবটাই হচ্ছে তাঁর লেখাজোখার অনন্য উপস্থাপনা আর চমকৃত হওয়ার মতো বিষয়বস্তু নির্বারনের জন্য।


দিন কয়েক আগে Oprah Winfrey এর বুকক্লাবের বই নিয়ে ১১৯তম আড্ডার মধ্য দিয়ে মেঘা মজুমদারকে অনেকটা‌ই স্পষ্ট করে জানার সুযোগ হলো। মেঘা মজুমদারের লেখা 'A Guardian and a Thief,' বইটি ২০২৫ ন্যাশন্যাল বুক অ্যায়ার্ডের ফাইন্যাল লিস্টে উঠেছে। Oprah Winfreyর মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানে সেই বইয়ের লেখক মেঘা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত পাঠকের নানা প্রশ্নের সাবলীল উত্তর দিয়ে মেঘা প্রমাণ করেছেন তিনি কেবল মাত্র লেখক হিসেবে নন, বক্তা হিসেবেও তুখোড়!

অনুষ্ঠান শুরু হতেই Oprah Winfrey মেঘার বইটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন: “এই উপন্যাস মাত্র ২২৪ পাতার এক মহাকাব্যিক বিস্ফোরণ। প্রথম পাতা থেকেই পাঠক ঢুকে পড়ে কলকাতার দুই পরিবারের সংঘর্ষে, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্ত জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়।” Thando নামের যে মেয়েটিকে Oprah মেয়ে বলেন, তিনিও নিজের প্রতিক্রিয়া জানান। বইটিকে Thando দেখেছেন নৈতিক দ্বন্দ্ব ও পারিবারিক দায়বদ্ধতার এক জটিল ছায়া হিসেবে।

খুব সংক্ষেপে মেঘা তার 'A Guardian and a Thief,' উপন্যাসের পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। দুটি পরিবার, এক শহর, এক অনিবার্য সংঘর্ষ। তিনি বলেন, “আমি কলকাতাকে শুধু পটভূমি হিসেবে নয়, চরিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি। তার কাছে দুর্ভিক্ষ নিয়ে লেখার অভিজ্ঞতা ছিল কঠিন। "আমরা ইতিহাসে যা ভুলে যাই, তা সাহিত্যে ফিরিয়ে আনা জরুরি,” চিরন্তন এই সত্যিটি জোরের সঙ্গে ব্যক্ত করেন মেঘা। একজন লেখক হিসেবে ব্যর্থতা সম্পর্কেও তার স্পষ্ট বয়ান: “ভুল করাই লেখার অংশ। ব্যর্থতা ছাড়া গভীরতা আসে না। প্রতিটি চরিত্র আমেরিকাকে ভিন্নভাবে দেখে---কেউ আশার চোখে, কেউ শঙ্কার।

বইটির পটভূমি এবং শিরোনামের প্রতি ইঙ্গিত করে Oprah প্রশ্ন করেন, “তাহলে কি সবাই একই সাথে অভিভাবক এবং চোর?” তার উত্তরে চমৎকৃত হওয়ার মতো মেঘার উত্তর: “হ্যাঁ, আমরা সবাই কিছু রক্ষা করি, আবার কিছু ছিনিয়ে নিই।” চাপে থাকলে মানুষ কেমন আচরণ করে; এই প্রশ্নের উত্তরে মেঘা বলেন, “চাপ আমাদের সত্যিকারের মুখোশ খুলে দেয়।”

'A Guardian and a Thief' এর অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব নিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন তৈরি হোক। চরিত্রগুলো কতটা ঠিক বা ভুল সেই প্রশ্ন করুন, লেখক হিসেবে মেঘার এমনটাই চাওয়া।

প্রসঙ্গক্রমে মেঘা নিজের আমেরিকার প্রবাসী জীবনের গল্প বলেন। এক অভিবাসী লেখকের চোখে দেখা দেশটা কেমন, সেখানে আশার সঙ্গে কতখানি আশাভঙ্গ আর অস্বস্তি জড়িয়ে থাকে অকপটে সেকথা জানান।

আলাপের শেষধাপে Oprah জানতে চান, “তুমি কি শুরু থেকেই জানতে উপন্যাসের পরিণতি কী হবে?” তার উত্তরে মেঘা বলেন:“শেষটা আমার কাছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে; চরিত্ররা যেন হাত ধরে আমাকে পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে।” লেখালিখির সঙ্গে মেঘার গাঁটছড়া বহুদিনের এবং নিবিড়, এই কাজটি তাকে তীব্রভাবে বেঁচে থাকার আশ্বাসের জোগান দেয়।

Oprah০এর অনুষ্ঠানটির কারণে মেঘাকে অনেকখানি জানার সুযোগ হয়েছে। তার লেখাজোখা পড়বার জন্য মুখিয়ে রইলাম। আগামী ১১ নভেম্বর ন্যাশন্যাল বুক অ্যাওয়ার্ডের বিজয়ীর নাম ঘোষিত হবে। মেঘা মজুমদারের হাতে পুরস্কারটি উঠলে সাহিত্যপ্রেমী প্রচুর বাঙালির মতো অপার আনন্দ হবে। বিজয়ী মেঘার আনন্দে আমরাও তুমুলভাবে আনন্দে জেগে উঠবো।


শুরুতে আরেক বাঙালি লেখককে নিয়ে বলেছিলেন। যাঁর নাম এবার নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ জোরেশোরে শোনা গিয়েছিল। সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত জাদরেল ব্রিটিশ সাহিত্যিক সালমান রুশদি'র নাম। বলছি অমিতাভ ঘোষের কথা। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত হিসেবে সুইডিশ রয়েল একাডেমি কর্তৃক তাঁর নাম ঘোষিত না হলেও আন্তর্জাতিক সাহিত্যের জগতে অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ একটি পুরস্কার প্রাপক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষিত হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো তিনি যে পুরস্কারটি পেয়েছেন, সাহিত্য জগতের অনেকের কাছে সেটি দ্বিতীয় নোবেল হিসেবে পরিচিত।

কোরিয়ার সাহিত্য জগতের অত্যন্ত সম্মানিত পুরস্কার 'পাক কিয়ংনি -এর জন্য ২০২৫ সালের নির্বাচিত সাহিত্যিক হলেন অমিতাভ ঘোষ। অমিতাভ ঘোষকে তাঁর আজীবন সাহিত্যকর্মের জন্য এই সম্মান দেওয়া হয়। ১৪তম পাক কিয়ংনি পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে অমিতাভ সেই প্রবাসী লেখকদের কাতারে যুক্ত হলেন, যাঁদের সাহিত্যকর্ম সংস্কৃতি, পরিবেশ, ইতিহাস ও স্মৃতির সীমা অতিক্রম করে এক নতুন ভাষ্য নির্মাণ করে। পাক কিয়ংনি পুরস্কারটি মূলত ২০১১ সালে তোজি কালচারাল ফাউন্ডেশনের হাত ধরে প্রবর্তিত হয়। পুরস্কারের নামকরণ করা হয়েছে প্রয়াত কোরিয়ান ঔপন্যাসিক পাক কিয়ংনি (১৯২৬–২০০৮)-এর নামে। পাক কিয়ংনি, তাঁর মহাকাব্যিক উপন্যাস Toji (The Land)-এর জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। এই পুরস্কার আজীবন সাহিত্যিক অবদান এবং সেই নৈতিক এবং কল্পনাপ্রসূত দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান জানায়। ফাউন্ডেশনের মতে এই পুরস্কার পাক কিয়ংনির সাহিত্যিক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে।

এর আগে যাঁরা সম্মানজনক এই পুরস্কার লাভ করেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক ম্যারিলিন রবিনসন (২০১৩), অ্যামোস ওজ (২০১৫), এনগুগি ওয়া থিয়োঙ্গ’ও (২০১৬), এ. এস. বাইয়াট (২০১৭), এবং ইসমাইল কাদারে (২০১৯)। অমিতাভ ঘোষ বহু দশক ধরে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। অমিতাভ ১৯৫৬ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ভারত ও যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেন। অমিতাভ এমন এক সাহিত্যভান্ডার নির্মাণ করেছেন, যা গড়পড়তা শ্রেণিবিন্যাসের বাইরে। তাঁর কথাসাহিত্য ইতিহাসনির্ভর, ভৌগোলিক ও সময়গত বিস্তারে সমৃদ্ধ, এবং পরিবেশ ও সভ্যতাগত ভাবনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তাঁর প্রবন্ধ-রচনাও তীক্ষ্ণ, জরুরি, এবং নৈতিকভাবে সংবেদনশীল। বিশেষত এমন এক সময়ে তিনি এই পুরস্কারটি পেলেন, যখন জলবায়ু সংকট, বাস্তুচ্যুতি, এবং ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার শুধু প্রেক্ষাপট নয়, বরং অস্তিত্বগত বাস্তবতা।

অমিতাভের উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে: The Shadow Lines (১৯৮৮), The Glass Palace (২০০০), Ibis TrilogySea of Poppies (২০০৮), River of Smoke (২০১১), Flood of Fire (২০১৫), The Hungry Tide (২০০৪), Gun Island (২০১৯), The Great Derangement: Climate Change and the Unthinkable (২০১৬), এবং The Nutmeg’s Curse: Parables for a Planet in Crisis (২০২১)। তাঁর রচনায় পুনরাবৃত্তির ঝোঁক লক্ষণীয়। এছাড়াও অন্যান্য থিমগুলোর মধ্যে রয়েছে: প্রবাস ও অভিবাসন, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের ভার ও মুছে যাওয়া স্মৃতি, পাশাপাশি মানবসমাজ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ক। ঘোষের লেখনী বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতি নিজেই একটি পূর্ণাঙ্গ চরিত্র। যা শুধু মানুষের নাটকের মঞ্চ নয়, বরং যার রয়েছে এক জীবন্ত উপস্থিতি, এবং কখনও কখনও এক নিপীড়িত সত্তা।

যদিও এই পাঠক তাঁর মাত্র দুটি বই পড়েছে। এবং তাতেই তাঁর লিরিক্যাল লেখনীর ভক্ত হয়ে গেছে। তাঁর 'ভাটির দেশ' এবং 'জঙ্গলনামা' সাকুল্যে এই দুটি পড়ার অভিজ্ঞতা জমা রয়েছে এই পাঠকের ঝুলিতে। তবে তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ- সাক্ষাৎকার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর 'The Shadow Lines' বইটি উপহার হিসেবে পেয়েছি কিছুদিন আগে। সেটা অচিরেই পড়ার সৌভাগ্য হবে বলে আশা রাখি। প্রিয় অমিতাভ ঘোষকে দ্বিতীয় নোবেল প্রাপ্তিতে আন্তরিক অভিনন্দন-ভালোবাসা জানাচ্ছি।

ঋণস্বীকার: Oprah's Book Club, Daily Planet












মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাদ যাবে কি মুজিব(বাদ!)?

শান্তির ছদ্মবেশে কি স্বাধীনতাহরণ?

'সখী, ভালোবাসা কারে কয়!'