ইতিহাস, তুমি মনে রেখো...
১৯৭১ সালের বর্ষাকাল। যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে যান রংপুরের এক যুবক। তাঁর অপরাধ, আরো হাজারো মানুষের মতো তিনিও শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পরাধীন পূর্ব বাংলার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন। অখণ্ড পাকিস্তানের তাবেদারেরা সেটা সহজে মেনে নেয় কী করে! 'জয় বাংলা'র পরিবর্তে তাদের আত্মার স্লোগান যে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ'। স্বাধীন বাংলাদেশ চাওয়ার মোক্ষম শাস্তি দেওয়া দরকার।কাজেই তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের অপরাধে বাড়িঘরের সর্বস্ব লুট করে, তাঁর ছমাসের গর্ভবতী স্ত্রীকে একদফা ধর্ষণ করার পরে রংপুর টাউন হলে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।পরবর্তী উনিশ দিন ইসলামের লেবাসধারী পশুরা লাগাতার ধর্ষণ করেছিল সেই যোদ্ধার স্ত্রীকে। যার পরিণতি হয় করুণ, হতভাগ্য গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যায়। পাকিস্তানি আর্মির সঙ্গে পুরো ঘটনাটি পরিচালনা করেছিল তৎকালীন পূর্ববাংলার বাঙালি রাজাকার নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুর এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহদাহ সহ ৯ ধরনের ৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছিল আজহারের বিরুদ্ধে। আওয়ামীলীগ শাসনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর উজিয়ে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই গণহত্যাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। ২০১৯ সালে আপিলের পরেও এই রায় বহাল রেখেছিল সুপ্রিম কোর্ট ।
বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের মেধাবী 'বিপ্লবের' পক্ষে প্রোপাগান্ডা লিখে, ওয়েবসাইট বানিয়ে, পডকাস্ট চালিয়ে একটানা প্রচার করানো হয়েছিল দেব-ভাদুড়ি-দস্তিদারদের মতো কলকাতার প্রগতিশীল বামপন্থীদের দিয়ে। তাদের 'মেধাবী' বাংলাদেশি সাথীরা আজ বেকসুর খালাস করে ছাড়িয়ে নিয়ে এলেন মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধী এটিএম আজহারুল ইসলামকে। মেধাজঙ্গিরা দেশ দখল করার পরে বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেল। বাংলাদেশ জুড়ে তাই অকাল ঈদের আনন্দে মেতেছিল জামাতপন্থীরা। একই সঙ্গে এই আফসোসের অনুরণনও শোনা গেছে, আজহারুলের মতো সাঈদী, কাদের মোল্লা, সালাউদ্দিন কাদের প্রমুখেরাও বেকসুর খালাস পেতে পারতেন!!
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের দোসর হিসেবে আজহারুল পাখি শিকারের মতো মানুষ হত্যা করতো, তাকে মুক্তি দিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকার ইউনুস বাহিনী যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রাখলেন ইতিহাস, তুমি তা মনে রেখো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর লক্ষ শহীদের সঙ্গে করা এই বেঈমানি তুমি ভুলে যেও না। ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মা আর হাজার হাজার বীরমুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করা হলো, সেটা যেন বিস্মৃতের অতলে তলিয়ে না যায়। আড়াই লক্ষ মা-বোনের আর্তনাদ, অশ্রুজল তুমি সযত্নে তুলে রেখো ইতিহাস- হাত গ'লে পড়ে যেতে দিও না।
এই আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা সাজা ঘোষণা করেছিলেন। গণহত্যা, হত্যা ও অগ্নিসংযোগ। এবং এই তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় যা ফাঁসি দিয়ে কার্যকর করতে বলা হয়। দ্বিতীয় তালিকাভুক্ত অপরাধগুলো ছিল ধর্ষণ, অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের। এই অপরাধগুলোতে মোট ৩০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তৃতীয় অভিযোগটির সপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণ না মেলায় ট্রাইব্যুনাল তাকে নির্দোষ ঘোষণা করেছিল।
আজহারুলের মুক্তিপ্রাপ্তি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক এবং বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের আইন উপদৃষ্টার উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়বার মতো। ঘাতকদালালদের বিচার নিয়ে ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যখন সোচ্চার হয়েছিলেন, তখনও জনাব আসিফ নজরুলের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়বার মতো। ইতিহাস ঘনিষ্ঠজনেরা সেসব জানেন। আমরা হয়তো আত্মবিস্মৃত জাতি, কিন্তু ইতিহাস তার ভাঁড়ারে সব নথি-তথ্য উপাত্ত সযত্নে জমা রাখে।
গণহত্যাকারী আজহারুল ইসলামের মুক্তির তারিখ: ২৪ মে ২০২৫
ঋণ স্বীকার: Soham Paul, ছবি: অন্তর্জাল থেকে

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন