Cry, Heart, But Never Break
“Cry, Heart, But Never Break”, নজরকাড়া ছোট্ট এই বইটি শিশুদের জন্য লেখা স্রেফ গল্প মাত্র নয়, বরং জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যিটিকে গল্পের ছলে, অসামান্য উপস্থাপনার এক অনন্য উদাহরণ। যা বড়দের পাঠ তালিকাতেও স্বমহিমায় থাকার যোগ্য। এ বইয়ের লেখক Glenn Ringtved. গ্লেন একজন ডেনিশ লেখক, মূল ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন রবার্ট মূলথ্রাপ(Robert Moulthrope)। জলরঙে নজরকাড়া ছবি দিয়ে বইটি সাজিয়েছেন শার্লট পার্ডি(Charlotte Pardi)। এঁরা প্রত্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিখ্যাত মানুষ।
আমরা যে সমাজে বেড়ে উঠেছি সেখানে অলিখিত এবং প্রচলিত কিছু ধারণা, শিশুদের যতটা সম্ভব জীবনের গূঢ় বাস্তবতা থেকে দূরে রাখা ভালো। একটা নির্দিষ্ট বয়সে তারা সেসব জেনে বুঝে নেবে। ফলে শিশু বয়সে যখন অযাচিত কোনো ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়, তখন সেটা একজন শিশুর জন্য নিদারুণ এক অবস্থা তৈরি করে। অবশ্য প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখনকার শিশুদের কাছে কোনো কিছুই হয়তো আর অজানা থাকে না।
কঠিন বাস্তবতার ঘায়ে শিশুর শৈশব ছিনতাই হোক সেটা কারো কাম্য না– জীবনের কিছু কিছু সত্যি, শিশুদের বোধের সঙ্গে খাপ খায়, সেভাবে তুলে ধরলে তাদের মনোজগতে ভীষণ উলট-পালট ঘটতে পারে বলে মনে হয় না। যেমন জীবন-মৃত্যুর মতো চিরন্তন সত্যি নিয়ে লুকোছাপায় না গিয়ে গল্পে গল্পে, অবশ্যম্ভাবী এই বিষয়টিকে তাদের সামনে তুলে ধরা সম্ভব।
“Cry, Heart, But Never Break” বইটিতে গ্লেন সেই কাজটিই করেছেন দারুণ দক্ষতায়। মৃত্যু নিয়ে শিশুদের সঙ্গে কথা বলার সাহসী প্রয়াস এটি, যেখানে ভয় বা আতংক তৈরি নয়, বরং গভীর মমতা নিয়ে বোঝাপড়া আর ভালোবাসা মুখ্য হয়ে ওঠে। এ বই-এর মূল বার্তা, “Cry, Heart, but never break” কেবলমাত্র শিশুদের জন্য নয়, বড়দের জন্যও একটি শিক্ষণীয় জীবনদর্শন।
বইয়ের গল্পটি ভারি মন কেমনের। মৃত্যু পথযাত্রী এক গ্র্যান্ডমাকে কিছুতেই বিদায় জানাতে রাজী নয় তাঁর আদরের চার নাতি-নাতনি। তারা অবুঝ- মৃত্যু সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্রও ধারণা নেই। গ্র্যান্ডমা’টিকে মৃত্যুপুরীতে নেবার জন্য মর্তে এসেছে মৃত্যু স্বয়ং। চার শিশু তখন বুদ্ধি আটে কিছুতেই তারা তাদের গ্র্যানিকে নিয়ে যেতে দেবে না। রাতের অন্ধকারের সঙ্গে মৃত্যু অর্থাৎ অশুভের যোগ। তাই তারা বুদ্ধি করে মৃত্যুকে কফি খাইয়ে কোনোভাবে রাতকে দিনের আলোর কাছে নেবার ‘শিশুভোলানো’ চেষ্টায় নামে। মৃত্যু শিশু চারজনের প্রতি সদয় হয়ে শোনায় একটি চমৎকার গল্প। গল্পে গল্পে মৃত্যু তাদের জীবনের গূঢ় মন্ত্রটি জানিয়ে দেয় – দুঃখ বিনা সুখ বড্ড পানসে। আলো যেমন সত্য- পাশাপাশি অন্ধকারও। তাই জীবনে আঘাত পেলে “কাঁদো, কিন্তু ভেঙে পড়ো না।” যা চার শিশুর ভেতর মৃত্যু সম্পর্কে এক নতুন বোধের জন্ম দেয়। গল্প শোনার পর তারা বুঝতে পারে, দুঃখ ছাড়া আনন্দের কোনো মানে নেই। চোখের জল ছাড়া হাসির গভীরতা বোঝা অসম্ভব। বিষণ্ন সুন্দর এক গল্প আর তার সঙ্গে মায়াকাড়া ছবি দিয়ে গ্লেন যেভাবে জীবন-মৃত্যুর দর্শনটিকে তুলে ধরেছেন, একথায় তা অসাধারণ! মৃত্যু এখানে কোনো নিষ্ঠুর শক্তি নয়, বরং এক গল্প বলা চরিত্র, যে শিশুদের বোঝায়—জীবন ও মৃত্যুর সহাবস্থান আমাদের মনুষ্য জগতের জন্য এক অমোঘ সত্যি।
বইটি পড়ার সময় আমার মনে হয়েছে, এটি শুধু শিশুদের জন্য নয়, বরং আমাদের সকলের জন্য। যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, যারা শোককে ভাষা দিতে চান, কিংবা যারা জীবনের অনিবার্য সত্যিকে আলতো ছোঁয়ায় ছুঁতে চান, তাদের সবার জন্য এই বই এক শান্তির আশ্রয়। এমনকী যে শিশুরা এখনো মৃত্যু কী, কেন মানুষের জন্য মৃত্যু অনিবার্য— এই সত্যির মুখোমুখি হয়নি, তাদের জন্যও বইটি পড়া আবশ্যিক মনে করি।
এ বই শেখায়, শোক মানে শুধু কান্না নয়, বরং এক গভীর উপলব্ধি। হৃদয় কাঁদে, কিন্তু ভাঙে না। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের পরম প্রিয়জনকে আমরা বিদায় জানাই। কিন্তু পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়া সেই প্রিয়জনেরা ভালোবাসার ওমে আমাদের বুকের খাঁজে থেকে যান আজীবন।
ছবি: মূল বই-এর প্রচ্ছদ- ইলাস্ট্রেশন করেছেন Charlotte Pardi

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন