ফুলগুলো সব কোথায় গেল?
কয়েক মাস ধরে আল-শুজাইয়া এলাকায় যুদ্ধ চলার পর, যে জায়গাটি একসময় ছিল প্রাণ প্রাচুর্যের ভরপুর- তার সবকিছুই হারিয়ে গেল। না কোনো ঘরবাড়ি, না মানুষ, না সেই চেনা জগতের কোনো চিহ্ন। তৃতীয়বারের আগ্রাসনের পর অঞ্চলটি পরিণত হয় এক প্রেতনগরে। আমার চির চেনা আল শুজাইয়া নীরবতা আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে কবর হয়ে পড়ে রইলো।
গণহত্যার সেই সময়ে, তখনো যখন আমাদের ঘর ছাড়তে হয়নি, আমি প্রায়ই সূর্যাস্তের সময় ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াতাম। সঙ্গে থাকতো আমার পাঁচ বছর বয়সি ছোটো বোন মারাহ। আমি আকাশ, মেঘ, তারা দেখতাম, কেবল নিচের দিকে ভুলেও তাকাতাম না। নিচের জমিন রক্ত আর ধ্বংসে ভেসে যাচ্ছে। এতবার আমাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে যে মনে হতো মাটিও বুঝি আমাদের দেখছে।
মারাহ আর আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হালকা হাসি-ঠাট্টা করতাম, চারপাশের ভয়াবহতা থেকে একটু পালানোর ছুতো খুঁজে নেওয়া। এক সন্ধ্যায় সে জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি তারাকে হাতে নিতে পারি?” আমি আকাশের দিকে তাকালাম। কিন্তু তার আগেই সে বলে বসলো, "তারা ওরকম অন আর অফ হয় কেন, নাদেরা?”
আমারও তো তাই ভাবনা, এই রক্ত আর ধ্বংসের মধ্যেও তারারা কীভাবে এখনো জ্বলে?
মারাহ আবার বলল, “আমি কি তারাটাকে ছোটো করে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পারি, যেন রাতে দেখতে পাই?”
রাতে ঘুমানোর আগে আমার ভাইবোনেরা গল্প শুনতে চাইতো। বিদ্যুৎ না থাকায় বই পড়ার সুযোগ হতো না বলে আমি নিজেই গল্প বানাতাম। যখন মারাহ তারাটা ছোটো করার কথা বলল, আমি নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। এতো ছোট্ট একটা শিশু এত বিশাল, উজ্জ্বল স্বপ্ন দেখে, এই চিন্তায় সব ভুলে আমি আপ্লুত ।
হঠাৎ করেই সে সজোরে ইউটিউব থেকে শেখা ওর প্রিয় ইংরেজি একটা গাইতে শুরু করলো "You are my sunshine, my only sunshine, you make me happy when skies are gray..." আমি বললাম, নিচু গলায় গাও, কিন্তু মনে মনে চাইছিলাম- তাবত পৃথিবী শুনুক ওর গান। অন্তত কিছুক্ষণ ও যেন খুশি থাকে, এই দুঃস্বপ্নের মধ্যে।
এটা সেই সময়, যখন দক্ষিণ থেকে উদ্বাস্তু মানুষেরা ফিরে আসেনি। গান গাইতে গাইতে মারাহ জিজ্ঞেস করলো, “ খালারা কি আমার গান শুনতে পাচ্ছে?” তারা তখনো দক্ষিণে, এক বছরের বেশি সময় তাদের দেখা পাইনি। তারপর একসময় অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “সূর্য কি খালাদের দেখতে যাবে?”
আমি কীভাবে ওকে বোঝাবো, আমরা তো একই শহরে থাকি, কেবল কয়েক কিলোমিটারের ব্যবধান, কিন্তু মাঝখানে চেকপয়েন্ট, বাধা আর সহিংসতা।
তার প্রশ্ন থামছিল না, অথচ সব প্রশ্নের সদুত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। ওকে বলতে দিয়ে আমি মৌন হয়ে রইলাম ।
ভয়ানক এক বিস্ফোরণে আকাশ আলোকিত হয়ে উঠল। দূরে আগুনের গোলা আর লাল-কালো ধোঁয়ার মেঘ উঠল, যেন কোনো আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়েছে। শব্দটা ছিল বধির করে দেওয়ার মতো। সেই ধোঁয়া ঘুরে ঘুরে নানা আকৃতির রূপ নিচ্ছিলো। আঙুল তুলে মারাহ বলল, “দেখো! ওইটা একটা গাছ! কিন্তু গাছ তো সুন্দর হয়, ওটা একদমই সুন্দর না।” তারপর সে হেসে উঠল, “গাছের গুঁড়িটা কেমন কাত হয়ে আছে দেখো!”
আমি যেখানে দেখছিলাম মৃত্যু, ও দেখছিল একটা গাছ। আমি ভাবছিলাম- এই মুহূর্তে কত শিশুর প্রাণ গেল? কতগুলো আত্মা হারালো এক ক্ষেপণাস্ত্রে? কেন এখনো আমাদের ওপর এই অনাচার হচ্ছে? কবে আমরা সাধারণ মানুষের মতো একটা সাধারণ জীবন পাবো?
মারাহর প্রশ্নে আমি বাস্তবে ফিরলাম, “তারাটা কি ধোঁয়ার সঙ্গে ধাক্কা খেতে পারে?” সে জিজ্ঞেস করলো। “যদি আমরা ওখানে থাকতাম, তাহলে কি আমরাও মারা যেতাম?”
আমার ছোটো বোন চার দিকের নাম জানে। সে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “ওটা হলো দক্ষিণ দিক, খালারা ওখানেই। আর ওই দিকে সাগর। কবে যাবো আমরা সমুদ্রে, নাদেরা?”
এক রাতে, আমি শুনলাম ঘুমের ঘোরে ও বিড়বিড় করে আমাদের এক কাজিনের নাম বলছে। সকালে সে বলল, “আমি স্বপ্নে দেখেছি, কাজিন দক্ষিণ থেকে এসেছে আর আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।”
২০২৫ সালের মে মাসে, যুদ্ধ শুরুর পর প্রথমবার মারাহ সাগর দেখতে গেল। আমরা গিয়েছিলাম এমন একজন আত্মীয়ের বাসায় যিনি উপকূলের কাছাকাছি থাকেন। নীল দিগন্ত দেখে সে চিৎকার করে উঠল, “সাগর! চল যাই, বাবা!” বালিতে পা দিয়েই সে হেসে উঠল আর দৌড়ে গেল ঢেউয়ের দিকে। তারপর সে বলল, “খেলনার দোকানদারেরা কোথায়, নাদেরা? বিচে কেউ নেই কেন? সবাই কোথায় গেল?”
আমি প্রায়ই ওর আঁকাআঁকি দেখি। এক পাশে সে আঁকে ক্ষেপণাস্ত্র, সৈন্য আর এক শিশু যাকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। অন্য পাশে আঁকে রংধনু, গোলাপ, আর সুন্দর বাড়ি।
আমি সবিস্ময়ে দেখি-কী অসাধারণ কৌতূহল ওর ভেতরে। বারবার প্রশ্ন করে চলে। ধ্বংসস্তূপের মাঝেও সে সৌন্দর্য খুঁজে পায়। আমি কৃতজ্ঞ যে ও এখনো হাসে, আকাশভরা সূর্যতারা নিয়ে ভাবে, স্বপ্ন দেখে এক উজ্জ্বল আগামীর। কিন্তু, এই জীবন কোনো শিশুর প্রাপ্য নয়। হতে পারে না।
আমাদের দানবীয় লোভের করাল গ্রাসে পৃথিবীর কোনো এক যুঝতে থাকা জাতির ফুলের মতো শিশুরা অসময়ে থরে থরে ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ ওদের এখন খেলে বেড়ানোর সময়। একটা বিকেল একটা ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছন ধাওয়া করে ফুরিয়ে ফেলার সময়। বাগানের ঘুম কাতুরে মালির ঘুমের সুযোগ নিয়ে ফুলগুলো সব উপড়ে নিচ্ছে দানবের হাত-- গোটা পৃথিবী তার নীরব সাক্ষী। ঘোর ভাঙলে হয়তো ঈশ্বর কিংবা মানুষ কিংবা ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা কোনো দীর্ঘশ্বাস প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে-- ফুলগুলো সব কোথায় গেল! ঈশ্বরের কাছে নিশ্চয়ই তার উত্তর আছে। আছে কি?
[ নাদেরা রাইদ মাসুদা'র " মাই সিস্টার আস্কস মী ফর অ্যা স্টার" এর ভাবানুবাদ]
"Innocent cries
Innocent lives
Where do they go
Where do they hide
They wanna play
They wanna stay
No more good byes T
o young to die
They just want hope
That they can grow
Achieve all their goals .
They just want hope
That they can grow
Achieve all their goals
We have a dream
And we believe
One day they’ll be free
Children of Gaza
The ummah is with you
The world is with you too
We’ll never leave you..."
ছবি ঋণ: অন্তর্জাল
by Omar Esa

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন